রক্ষকই কি ভক্ষক? লোকসভা ভোটের ময়দানে কতটা স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা?

Election Commission: গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব ভোট, আর সেই ভোট পরিচালনার দায় এবং দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা কতটা সুচারু ভাবে পালন করছে তাদের ভূমিকা, উঠেছে নানা মহলে প্রশ্ন।

দেশের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশ জুড়ে সাজো সাজো রব। প্রার্থীরা ব্যস্ত প্রচারে। ইতিমধ্য়েই প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ সারা। কিন্তু এই ভোটের ময়দানে একাধিক প্রশ্ন উঠে গিয়েছে ইলেকশন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব ভোট, আর সেই ভোট পরিচালনার দায় এবং দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা কতটা সুচারু ভাবে পালন করছে তাদের ভূমিকা, উঠেছে নানা মহলে প্রশ্ন।

গদি দখলের লড়াই বলে কথা। ভোটের লড়াইয়ে কারওর অস্ত্র ইস্তেহার, তো কারওর কুকথা, কেউ আবার বিভিন্ন ভাতা-প্রকল্পকে হাতিয়ার করে লোকসভা নির্বাচনে লড়ার জন্য তৈরি। ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে জারি হয়ে গিয়েছে নির্বাচনী আচরণবিধি। যা শাসক থেকে বিরোধী, সকলের মেনে চলার জন্য। কিন্তু সেই কোড অব কনডাক্ট ভেঙে ভোটপ্রচারে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে বসেছেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সে নিয়ে একাধিক অভিযোগ পাওয়ার পরেও তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ইলেকশন কমিশন। এমনকী এ বিষয়ে কোনও রকম হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দেয়নি কমিশন। কারণ তার পরেও মোদির মুখে শোনা গিয়ে স্পষ্ট মুসলিম  বিরোধিতার কথা। গত ২১ এপ্রিল রাজস্থানের একটি জনসভায় গিয়ে অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে মোদি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে 'ঘুসপেটিয়া' বলে বসেন তিনি। না, মোদিতেই শেষ নয়, বাংলায় এসে বিজেপিকর্মীদের মৃত্যুর প্রসঙ্গে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেও কুকথা বলতে শোনা গিয়েছে। মেমারি বিধানসভা এলাকার রসুলপুরের এক সভায় তিনি বলে বসেন, ‘‘আমি আজ বলে যাচ্ছি, যাঁরাই এই হত্যা করছে, আমাদের সরকার গঠনের পর সকলকে পাতাল থেকেও খুঁজে বার করে এনে জেলে পাঠানোর কাজ করবে বিজেপি।’’ অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ হেন হিংসাত্মক বক্তব্য নিয়েও মুখে কুলুপ নির্বাচন কমিশনের। 

এই সব দেখেশুনে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ইলেকশন কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়েও। এরই মধ্যে আবার প্রথম দুই দফার ভোটে ভোটারদের ভোটদানের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, দশ দিন আগে হয়ে যাওয়া প্রথম দফার ভোটে ভোট পড়েছে ৬৬.১৪ শতাংশ। অন্যদিকে, দ্বিতীয় দফায় ভোট পড়ার হার ৬৬.৭ শতাংশ। প্রথম দফার ভোট ছিল ১০২টি কেন্দ্রে, গত ১৯ এপ্রিল, দ্বিতীয় দফার ভোট ছিল গত ২৬ এপ্রিল। ওই দফায় ভোটগ্রহণ হয় মোট ৪৪টি আসনে। কেন সংখ্যা না প্রকাশ না করে শতাংশে ভোট পড়ার পরিসংখ্যান জানাল কমিশন। সে ব্যাপারটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সেই শতাংশের হিসেবে গড়মিল রয়েছে বলেও অভিযোগ। কারণ প্রথম দফার ভোটের পরে কমিশনের তরফে জানানো হয়েছিল, রোদ-গরমের ভ্রুকূটি অগ্রাহ্য করেও ৬৩.৮৯ শতাংশ ভোট পড়েছে প্রথম দফায়। তবে কেন দ্বিতীয় দফার ভোটের পর ভোট পড়ার অঙ্ক পাল্টে গেল। এক ধাক্কায় প্রায় তিন শতাংশ বেড়ে গেল প্রথম দফায় ভোটারদের অংশগ্রহণ। আর এ ব্যাপারটির মধ্যে ভালোই গড়মিল দেখতে পাচ্ছে ওয়াকিবহাল মহল। ২০১৯ সালে প্রথম দু-দফার ভোটে ভোটগ্রহণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬৯.৪৩% এবং ৬৯.৪৪ শতাংশ। ফলে ভোট পড়ার পরিমাণ চলতি ভোটে বেশ খানিকটা কমেছে। বিশেষজ্ঞ মহলের প্রশ্ন, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়ার আসল সংখ্যাটা প্রকাশ্যে আনল না নির্বাচন কমিশন। তাদের মতে, যতক্ষণ না আসল সংখ্যাটা জানা যাচ্ছে, ততক্ষণ এই শতাংশের কোনও দাম নেই। আর এর জন্য নির্হাচন কমিশনের দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন: কত ভোট পড়ল জানাতে এত দেরি! কারচুপি লুকোতে চাইছে নির্বাচন কমিশন?

তবে শুধু ভোটের অঙ্কেই নয়। নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আরও নানা ভাবেও। কিছুদিন আগেই গুজরাটের সুরাট কেন্দ্রে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় বিজেপি। কারণ ওই কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী নীলেশ কুম্ভানির মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায় শেষমুহূর্তে। শুধু নীলেশরই নয়। ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী মুকেশ দালালের বিপরীতে যাঁরা যাঁরা প্রার্থী দিয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অজ্ঞাত কারণে মনোনয়ন তুলে নেন। পরে জানা যায়, খোদ কংগ্রেস প্রার্থী যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। সুরাটের পর মধ্যপ্রদেশের ইনদওরের ঘটে একই রকম ঘটনা। সেখানকার কংগ্রেস প্রার্থী সকাল থেকে বেপাত্তা থেকে বিকেলে গিয়ে যোগ দেন বিজেপিতে। কৈলাশ বিজয়বর্গীয়-সহ বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতাদের সঙ্গে একই গাড়িতে দেখা যায় সেই কংগ্রেস নেতাকে। ফলে বিরোধীশূন্য, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ইনদওরের জিতে যায় বিজেপি। পরে জানা যায়, ভোটে দাঁড়াতেই কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে সতেরো বছরের একটি পুরোনো মামলা মাটি খুঁড়ে উপরে নিয়ে আসে, এবং তাতে খুনের ধারা থেকে শুরু করে আরও ভয়ঙ্কর কিছু ধারা যুক্ত করা হয়। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই কংগ্রেস প্রার্থীর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার নেপথ্যের আসল কারণটা।

আর সে ঘটনাতেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে। একদিকে যেখানে নির্বাচন কমিশন সমস্ত নাগরিকের ভোটাধিকার নিয়ে গালভরা কথা বলছে, প্রচার চালাচ্ছে, সেখানে সেই দেশেরই একটি অংশে ভোট দেওয়ার সুযোগটুকু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিজেদের গণপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার যে অধিকার তা একজন নাগরিকের সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার। সেখানে ভিতরে ভিতরে ঠিক হয়ে গেল কে গদিতে বসবে। এবং তাতে ন্যূনতম অংশগ্রহণও থাকল না মানুষের। আর তা নিয়ে টু শব্দ পর্যন্ত করল না নির্বাচন কমিশন। বারবার মোদি সরকার বলেছে, এক দেশ এক নির্বাচনের কথা। কিন্তু তা চালু হওয়ার আগেই ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হল মানুষ। সেখানে কী ভূমিকায় দেখা গেল নির্বাচন কমিশনকে। প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ সাকেত গোখলে, রাজনীতিবিদ যোগেন্দ্র যাদব থেকে শুরু করে বাম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির মতো ব্যক্তিত্বরা। নিজেদের এক্স হ্য়ান্ডেলে এ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁরা। 

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও। ভোট পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারাই যদি কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের ধামাধারী হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে গণতন্ত্রের স্তম্ভ নড়ে যায় বলেই দাবি অনেকের। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও তেমন কিছু হচ্ছে না তো? প্রশ্ন একটি অংশের। গত বছর ডিসেম্বরেই নির্বাচন কমিশন নিয়োগের রদবদল সংক্রান্ত আইন এনেছিল সরকার। সেই অনুযায়ী বর্তমানে নির্বাচন কমিটির সুপারিশে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক। নতুন আইন অনুয়ায়ী, সরকারের সংশোধনীর অধীনে, 'সার্চ কমিটি'-তে মন্ত্রিপরিষদের সচিবের পরিবর্তে আইনমন্ত্রী নেতৃত্বে থাকবেন। থাকবেন দুই সচিব। আইনমন্ত্রী ও দুই কেন্দ্রীয় সচিবের সমন্বয়ে গঠিত 'সার্চ কমিটি' পাঁচটি নাম বাছাই করে জমা দেবে নির্বাচন কমিটির কাছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি একটি নাম ঠিক করবেন। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের নিয়োগেও মাথা গলাতে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার। আর তার ফলে যা হতে পারত, তাই ঘটছে বলে মন্ত্ব্য করেছেন কেউ কেউ।

দিন কয়েক আগেই আম আদমি পার্টির প্রচারমূলক একটি গান নিষিদ্ধ করে দেয় নির্বাচন কমিশন। কেন? সেখানে নাকি আপ শাসক দল ও কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে বদনাম করা হয়েছে। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিতে শাসকের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর জোরালো করাটাই তো দস্তুর। অন্তত এতদিন তেমনটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু এবার সেটাই বড় কাঁটা হয়ে বিঁধেছে কমিশনের চোখে। অথচ বিজেপির একাধির নেতা এ দেশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে লাগাতার ঘৃণাভাষণ ছড়িয়ে চলেছেন, তা নিয়ে মুখে কুলুপ নির্বাচন কমিশন। আম আদমি পার্টির গান নিষিদ্ধ করার বিষয়টিকে শুধু স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তই নয়, রাজনীতির ইতিহাসে নির্বাচন কমিশনের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলেই দেখছে আপ-সহ অন্য়ান্য বিরোধিরা।

আরও পড়ুন: প্রশ্ন তুলছে সুরাট-ইন্দোর, এক দেশ এক ভোট এলে ভোটাধিকার থাকবে আদৌ?

নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা, যার কাঁধে নিরপেক্ষভাবে ভোট পরিচালনার ভার রয়েছে। কিন্তু ইদানীংকালে সেই জায়গা থেকে নির্বাচন কমিশন বিচ্য়ুত বলেই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। তার কারণ কি নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপে কেন্দ্র সরকার তথা বিজেপি সরকারের হস্তক্ষেপ। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারাই যদি নিরপেক্ষতার খোলস ছেড়ে ক্ষমতাশালী শাসকের পা ধরা শুরু করে, তাহলে দেশের গণতন্ত্র রক্ষা হবে কী উপায়ে? পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু ভোট সম্পাদনে তবে কি ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন, নাকি তারাও আজ বিজেপির হাতের পুতুল মাত্র, উঠেছে বিরাট প্রশ্ন।

More Articles