জিতেছিলেন বাবা-মা দু'জনেই! স্মৃতির থেকে আমেঠি ছিনিয়ে আনতে পারবেন রাহুল গান্ধি?

Amethi Lok Sabha History: রাহুল তাঁর প্রথম নির্বাচনেই আমেথি জিতে নেন। ২০০৯ সালে ৩.৭০ লক্ষ ভোটের বিশাল ব্যবধানে ফের নির্বাচিত হন তিনি।

আমেঠি আর রায়বরেলি। বহু যুগ ধরে ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে এই দুই লোকসভা আসন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে থেকেছে। দুই আসনেই বরাবর হাই-প্রোফাইল লড়াই হয়েছে, দুই আসনই কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি ছিল। রাজীব গান্ধি, সঞ্জয় গান্ধি, সনিয়া গান্ধি, এবং রাহুল গান্ধি, মতো নেহেরু-গান্ধি পরিবারের সদস্যরা বরাবর এই আসনে নির্বাচিত হয়েছেন৷ তবে খেলা তো ঘোরে। রং আর সময় দুই পাল্টে যায়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির স্মৃতি ইরানি কংগ্রেসের থেকে তাঁদের ঐতিহাসিক গান্ধি ঘাঁটি আমেঠি দখল করে নেন। আমেঠি পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। তিনটি বিজেপি এবং দু'টি সমাজবাদী পার্টির দখলে।

আমেঠি খুব গুরুত্বপূর্ণ আসন, খুব মিশ্র আসনও। এখানের ভোটাররা মূলত গ্রামীণ, ৯৬ শতাংশই গ্রামের, শহুরে মাত্র ৪ শতাংশ। তপশিলি জাতির মানুষ এখানে ২৬.৬ শতাংশ৷ ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে এখানে ৮৫ শতাংশ হিন্দু এবং ১৫ শতাংশ মুসলিম। গত পাঁচটি লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে, ভোটারদের পছন্দে স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। ২০০৯ সালে এই আসনে কংগ্রেস পেয়েছিল সর্বোচ্চ ৭১.৮ শতাংশ ভোট! আর ২০১৯ সালে বিজেপি এই আসনে জেতে ৪৯.৭ শতাংশ ভোটে। উল্লেখ্য, সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি একদা কংগ্রেসের এই শক্ত ঘাঁটিতে এবং এখন বিজেপির উঠতি আধিপত্যের এই আসনে কখনও জয়ী হয়নি।

আমেঠির সঙ্গে গান্ধি পরিবারের সম্পর্ক গভীর। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৮১ এবং ১৯৮৪ সালে শরদ যাদব এবং মানেকা গান্ধির মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজীব গান্ধির অপ্রতিরোধ্য জয় দেখেছে আমেঠি। ১৯৮৯ সালে বিএসপির প্রতিষ্ঠাতা কাঁশি রামের মতো নেতাদের প্রভাব এই আসনটিকে রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছিল।

আরও পড়ুন- প্রথম নির্বাচনে লড়ছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধি! ইন্দিরা, সনিয়ার পর পারবেন রায়বরেলি ধরে রাখতে?

১৯৬৭ সাল থেকেই আমেঠি কংগ্রেসের ঘাঁটি। ১৯৭০ এবং ১৯৯০-এর দশকের শেষের কিছু বছর বাদে, আমেঠির মানুষ চিরকালই নেহেরু-গান্ধি পরিবারের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। ২০১৯-এর ভোটে স্মৃতি ইরানি সমস্ত হিসেব পাল্টে দিলেন। ২০২৪ সালেও ফের রাহুল গান্ধি আমেঠি আসন থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আগের নির্বাচনে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে ৩৫,০০০ ভোটে এই আসনে হেরে যান রাহুল।

জরুরি অবস্থার অবসানের পরপরই সঞ্জয় গান্ধিই গান্ধি পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার জন্য জোর করে নির্বীজ করার কর্মসূচিতে জড়িত থাকার কারণে ভোটে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন তিনি। আমেঠির ইতিহাসে সেই প্রথম একজন অ-কংগ্রেসি নেতা জেতেন — জনতা পার্টির রবীন্দ্র প্রতাপ সিং।

অবশেষে ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ের স্বাদ পান সঞ্জয় গান্ধি। ওই আসনে সাংসদ হন তিনি। কিন্তু ১৯৮১ সালের বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর ফলে আমেঠি আসন ফের শূন্য হয়ে যায়। সঞ্জয় গান্ধির মৃত্যু রাজীব গান্ধির সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশের প্রথম সিঁড়ি। ১৯৮১ সালের ৪ মে, ইন্দিরা গান্ধি সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভায় আমেঠি থেকে প্রার্থী হিসাবে তাঁর ছোট ছেলের নাম প্রস্তাব করেন। রাজীব উপ-নির্বাচনে লোকদল প্রার্থী শরদ যাদবের বিরুদ্ধে ২ লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। ১৯৮১ সালের ১৭ অগাস্ট আমেঠি থেকে সাংসদ হিসেবে শপথ নেন তিনি। রাজীব গান্ধি প্রায় এক দশক আমেঠি আসনটি ধরে রেখেছিলেন। ১৯৮৪, ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ সালে জয়লাভ করেন তিনি। তারপর ১৯৯১ সালে লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলাম তাঁকে হত্যা করে।

তাঁর মৃত্যুর পর, কংগ্রেসের সতীশ শর্মা উপ-নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং ১৯৯৬ সালে ফের নির্বাচিত হন। দুই বছর পর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঞ্জয় সিং তাঁকে হারিয়ে দেন। বিজেপি সেবার উত্তরপ্রদেশে ৮৫টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৫৭টি আসন দখল করে।

১৯৯৯ সালে আমেঠিতে ফের প্রার্থী হন নেহেরু-গান্ধি পরিবারের সদস্য। রাজীবের স্ত্রী সনিয়া গান্ধি ওই নির্বাচনী আসনে থেকে লড়েছিলেন। কিন্তু ওই একই আসনে আবারও নির্বাচনে দাঁড়াননি তিনি। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সনিয়া রায়বেরেলি থেকে লড়েন। তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধি আমেঠি থেকে লড়েন।

রাহুল তাঁর প্রথম নির্বাচনেই আমেঠি জিতে নেন। ২০০৯ সালে ৩.৭০ লক্ষ ভোটের বিশাল ব্যবধানে ফের নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালেও রাহুল জেতেন, কিন্তু সেবার ছিল 'কাঁটে কা টক্কর'। বিজেপির স্মৃতি ইরানি সঙ্গে ভোটের লড়াই ছিল কঠিন। অবশেষে ২০১৯ সালে রাহুলকে হারিয়ে দেন স্মৃতি। কংগ্রেসের আশা, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই আসন নিজের পকেটে ফিরিয়ে আনবেন রাহুল। তথ্য বলছে, যে দলটি একসময় কয়েক দশক ধরে রাজ্য শাসন করেছিল, রাজনৈতিকভাবে ক্রমেই তলানিতে চলে যাচ্ছে তারা। অতিমাত্রায় ভোট কমেছে কংগ্রেসের।

আমেঠি সংসদীয় কেন্দ্রে পাঁচটি বিধানসভা আসন রয়েছে - তিলোই, সেলন, জগদীশপুর, গৌরীগঞ্জ এবং আমেঠি। ২০০৭ সালের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে এই পাঁচটি আসনে গড়ে কংগ্রেস ৩৪% ভোট পেয়েছিল। ২০১২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পায় ৩০%, ২০১৭ সালে ২৫% এবং ২০২২ সালে মাত্র ১৪%।

আরও পড়ুন- ১৮০-র বেশি আসন পেরোতে পারবে না বিজেপি! কেন এমন বলছেন রাহুল গান্ধি?

২০০৭ সালে, কংগ্রেস এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি বিধানসভা আসন জিতেছিল, অন্য দু'টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। ২০১২ সালে, দু'টি আসন জেতে কংগ্রেস, তিনটি আসনে হয় রানার আপ। ২০১৭ আর ২০২২ সালে কোনও আসনই জিততে পারেনি কংগ্রেস। ২০২২ সালে মাত্র একটি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। বাকি চারটিতে তৃতীয় স্থানে।

বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কি সংশ্লিষ্ট লোকসভা আসনের ফলাফলকেও প্রভাবিত করে না? নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, কখনও কখনও করে, কখনও আবার দুই আসনের ফলাফল একেবারে আলাদা হয় কিন্তু আমেঠির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের অবস্থান যে আর জোরালো না তা নানাভাবেই প্রমাণিত। ক্রমশই বিধানসভা আসন এবং ভোট হারাচ্ছে কংগ্রেস। ২০১৯ সালের ফলাফল ছিল ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধির নির্বাচনী হারের পর কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় ধাক্কা৷

২০২৪-এ কি তবে আমেঠিতে কোনও সম্ভাবনাই নেই রাহুলের? ইন্ডিয়া ব্লকের অবস্থা দেখে এখনও বিরোধীদের শক্তি আঁচ করা যাচ্ছে না। সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব তাঁর বাবা এবং উত্তরপ্রদেশের অন্যতম রাজনৈতিক নেতা মুলায়ম সিং যাদবের মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম নির্বাচনী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসপি এবং কংগ্রেস ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে একসঙ্গে লড়াই করেছিল কিন্তু সেই জোটের ফল ছিল দুর্দান্ত খারাপ। দলের নেতাকর্মীদের বনিবনা ছিল না। দুই দলই নিজেদের পকেটের ভোট টানতে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া এবার অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন সারা উত্তরপ্রদেশে বড় প্রভাব ফেলেছে। অন্যান্য অনেক রাজ্যের মতোই রাম মন্দির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যু। ফলে সেই গেরুয়া দাপটে কংগ্রেসের উপর আদৌ মানুষ আস্থা রাখবেন কিনা, রাহুলকে কতখানি ভরসা করেন আম জনতা তার উত্তর আমেঠি দেবে ২০ মে।

More Articles