প্রশ্ন তুলছে সুরাট-ইন্দোর, এক দেশ এক ভোট এলে ভোটাধিকার থাকবে আদৌ?

Lok Sabha Election 2024: কিছুদিন আগে খবর আসে, গুজরাতের সুরাট লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপির প্রার্থী মুকেশ দালালকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই একই ছবি দেখা গেল মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরেও।

এক দেশ, এক ভোটের কথা বলছেন মোদি-শাহরা। কিন্তু লোকসভা ভোটের বাজারে সুরাট ও ইন্দোর এক অন্য এক আশঙ্কার দিক উস্কে দিল। ভোটের পরে সরকার টলিয়ে দিতে বিধায়ক কেনাবেচা যে কোনও বড় ব্যাপার নয়, তা একাধিক বার দেখিয়েছে বিজেপি। তবে এবার এক অন্য ছবি দেখা গেল সুরাট ও ইন্দোরে। ভোট হওয়ার আগেই জয় পকেটে পুরল বিজেপি। কীভাবে? ওই দু'টি জায়গায় মনোনয়ন জমা দিয়েও তা প্রত্যাহার করে নিলেন কংগ্রেস প্রার্থীরা। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় বিজেপি। বেলা গড়াতেই দেখা যায়, সেই প্রার্থীটি যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে। গেরুয়া শিবির জানাচ্ছে, মোদির উন্নয়ন যজ্ঞে সামিল হতেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন সেই সব বিরোধী প্রার্থী। কিন্তু সত্যিই কি ততটাই সাদা-কালো এই সব ঘটনা? নাকি এর নেপথ্যে লুকিয়ে আরও বড় কোনও সত্য? মানুষ যে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, সে ব্যাপারেই বা কী পদক্ষেপ করছে নির্বাচন কমিশন।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সামনে এসেছিল চন্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনের একটি ঘটনা। যেখানে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা রিটার্নিং অফিসার স্বয়ং ব্যালট পেপার থেকে বিরোধীর পক্ষের ভোট নিজে হাতে কেটে, তার পরিবর্তে বিজেপির পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেস। সেই মামলায় অভিযুক্ত রিটার্নিং অফিসারকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিল শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম কোর্চের তরফে সাফ জানানো হয়, ওই রিটার্নিং অফিসার যেন ভুলে না যান, দেশে এখনও আইন আদালত অবশিষ্ট রয়েছে। আদালতের নির্দেশে শাস্তিও হয়েছিল অভিযুক্তের।

আরও পড়ুন: ভোটে-যুদ্ধে সব ‘জায়েজ’! কংগ্রেসকে পথে বসিয়ে কেন বিজেপিতে যেতে বাধ্য হলেন প্রার্থী?

বাংলায় অবশ্য এমন ঘটনা কোনও নতুন বিষয় নয়। গত ২০১৮ সালের কিংবা সম্প্রতি ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে, রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকায় কার্যত প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াই। যে রাজ্যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই থেকে শুরু করে ব্যালটের কাগজ খেয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা সম্ভব, তার কাছে চন্ডীগড়ের ঘটনা যে শিশু, তা বলাই যায়। তবে মেয়র নির্বাচন বা পঞ্চায়েত নির্বাচনের গণ্ডি ছাড়িয়ে এমন ঘটনা ঢুকে পড়েছে এখন দেশের সাংসদ নির্বাচনের মতো জরুরি ভোটেও। হয়তো এখনও পুকুরে কিংবা নালায় ইভিএম পড়ে থাকতে দেখা যায়নি, কিন্তু ইভিএম ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে আপাত-শান্ত মণিপুরে। শুধু তাই নয়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলের জয়ী হওয়ার খবর আসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই, যা নিশ্চিত ভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে আশঙ্কাজনক।

কিছুদিন আগে খবর আসে, গুজরাতের সুরাট লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপির প্রার্থী মুকেশ দালালকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। শোনা যায়, তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের নীলেশ কুম্ভানির প্রস্তাবকদের সই না মেলার কারণে মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, অন্যান্য যাঁরা সেই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাঁরাও মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেন। তারপরে অবশ্য সেই বিরোধী কংগ্রেস প্রার্থী কয়েকদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান, এবং পরে খবর মেলে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যেখানে বারবার ভোটে অংশ নেওয়ার জন্য প্রচার করে, সেখানে কমিশন কী করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই জয়কে সমর্থন করল? তাহলে কি সুরাটের নির্বাচকদের কোনো অধিকার নেই গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসবে অংশ নেওয়ার?

প্রশ্ন ওঠে, মানুষের ভোট ছাড়াই তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচনের এই অধিকার শাসক বিজেপিকে কে দিল? তাহলে কি শাসক দল ধরেই নিয়েছে যে সুরাটের মানুষের নোটাতে ভোট দেওয়ার অধিকারও নেই? তথ্য বলছে, গত নির্বাচনে বিজেপির যিনি সাংসদ হয়েছিলেন, তিনি বিপুল ব্যবধান জিতেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তো কিছু বিরোধী ভোট পড়েছিল। গণতন্ত্রের কাজই তো বিরোধী কন্ঠকে জোরালো করে তোলা। আর নির্বাচন কমিশন যখন এই কাজটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করাতে পারছে না, তখন সেই ব্যর্থতা কাদের?

সুরাটের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই, মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে সংসদীয় আসনে একই ছবি চোখে পড়ল। মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে, কংগ্রেসের প্রার্থী সকাল থেকে নিখোঁজ থাকার পর ঠিক দুপুরবেলা গিয়ে যোগ দিলেন বিজেপিতে। শুধু যে যোগ দিলেন তা-ই নয়, বিজেপির এক শীর্ষস্তরের নেতার সঙ্গে তাঁকে গাড়িতেও দেখা গেল। বিজেপির যুক্তি, নরেন্দ্র মোদির উন্নয়ন যজ্ঞে সামিল হতে কংগ্রেস প্রার্থী অক্ষয় বাম বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু বিষয়টা ততটাও সহজ-সরল নয়। মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেসের সভাপতি জিতু পাটোয়ারি বলছেন, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের তরফে অক্ষয় বামের নাম ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা পুরনো একটি ফৌজদারি মামলা নিয়ে ফের নাড়াচাড়া শুরু করে দেয় মধ্যপ্রদেশ প্রশাসন। সতেরো বছরের পুরনো মামলায় যুক্ত করা হয় খুনের অভিযোগ এবং ৩০৭ ধারা। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেস প্রার্থীকে ভয় পাইয়ে দেওয়াটাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। বুঝতে অসুবিধা হয় না কংগ্রেস প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ার নেপথ্যের আসল কারণটা। আর যার পিছনে কলকাঠি নেড়েছেন বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয়-সহ অন্যান্যরা।

কিন্তু আরো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সংসদীয় নির্বাচনের একজন প্রার্থীকে সবরকম নিরাপত্তা দিতে কংগ্রেসই বা কেন ব্যর্থ হচ্ছে বারবার? যদিও তারা তাদের নির্বাচনী ইস্তেহার নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে এবং সাড়াও পেয়েছে। তাদের ইস্তেহার নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহও তৈরি হচ্ছে, কিন্তু ভোটে জয় তো শুধু ইস্তেহারে আসে না, তার সঙ্গে লাগে মজবুত সংগঠন। সেই সংগঠন কি কংগ্রেসের আদৌ রয়েছে? নাকি তারা ভাবছে, শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করেই এবারের নির্বাচনের নদী পার করবে কংগ্রেস! হয়তো গত দশ বছরের এই বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষ বীতশ্রদ্ধ, হয়তো অস্বাভাবিক বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধি অনেকাংশে এইবারের নির্বাচনে বিরোধীদের কথা বলার জায়গা বাড়িয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা লাগে তা দৃঢ়তা। আর সেটা কি নীচের তলার কংগ্রেস কর্মীদের আদৌ রয়েছে? একদিকে রাহুল গান্ধী বলছেন, 'ডরো মাত', অর্থাৎ বিজেপিকে ভয় পেতে বারণ করছেন তিনি। আর ওদিকে সেই কংগ্রেসের নীচের তলার কর্মীরা সেই ভয় পাচ্ছেনই। হয়তো বেশ কিছু রাজ্যে তারা ভালো ফল করবে, তার কারণ কিন্তু শুধুমাত্র রাহুল গান্ধী বা তাঁর 'ভারত জোড়ো যাত্রা' নয়। তার কারণ সেই রাজ্যের কংগ্রেসের সংগঠন। কিন্তু সমস্ত রাজ্যে কি প্রধান বিরোধী স্বর হয়ে উঠতে পারছে কংগ্রেস? এই রাজ্যের উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। যে বাইরন বিশ্বাস কংগ্রেসের টিকিটে একটি উপনির্বাচনে জিতে কিছুদিনের মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে সামিল হতে যান, সেই বাইরন বিশ্বাসকে কি এই রাজ্যের কংগ্রেস আটকাতে পেরেছিল?

আরও পড়ুন: ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট মেলালেই ভোটারদের ভোট সঠিক জায়গায় যাবে?

এরপরেও আরও কিছু কথা থাকে। এই মূহুর্তে শাসক বিজেপি সুরাট এবং ইন্দোরে যা করল, তা কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রে একটি লজ্জাজনক ঘটনা হয়েই থেকে যাবে। এই প্রবণতা কি দেখিয়ে দেয় না, আগামী নির্বাচনে যদি বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফেরত আসে এবং নরেন্দ্র মোদী দি আবার প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে যা হতে চলেছে তা দুশ্চিন্তার। সত্যিই কি গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের প্রতিটি সংস্থাকে নিজেদের দখলে নিয়ে আগামীতে কোনও নির্বাচনেরই জায়গা রাখবে না বিজেপি? তেমনটাই কি ইঙ্গিত দিচ্ছে সুরাট এবং ইন্দোর। নির্বাচনের পরে ঘোড়া কেনা বেচা হয় (সাংসদদের কেনা হয়) জানা কথা। কিন্তু এবারের নির্বাচনে দেখা গেল, ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। এই লক্ষণ কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর। আগামীতে 'এক দেশ এক ভোট' হতে চলেছে, নাকি এক দেশ কোনও ভোট নয়-এর মতো নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে চলেছি, তার চাবি কিন্তু নির্বাচকদের হাতেই। একমাত্র তাঁরাই পারেন, ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে।

More Articles